'অকূলে '
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ০৬ জানুয়ারি, ২০১৫, ০৬:১৩:৪০ সন্ধ্যা
বিবাহিত জীবনে বিচিত্র অনুভূতির ভিতর দিয়ে বিশটি বছর পার করেছে সেহেলি। সবাইকে সুন্দর ভাবে ম্যানেজ করে চলছিল।
কিছু পাওয়া আর অনেক কিছু না পাওয়ার ভিতর দিয়ে বছর বছর বয়স বাড়ছিল। এক সময় সে খেয়াল করল জীবন কাটাতে কাটাতে তার জীবনের প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে। মনে মনে তার জীবনের সাথে যুক্ত সবার কাছ থেকে, সব প্রয়োজন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে শুরু করেছে নিজেরই অজান্তে । জীবনের শুরু থেকে চারপাশের সবার অবিরাম প্রত্যাখ্যান আর সেই প্রত্যাখ্যান থেকে কৌশলে টিকে থাকার উপায় বের করতে করতে সে চরম ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে । তার বিশ্রাম দরকার। তার আর কিছু চাইতে ইচ্ছে করছে না। সম্পর্কগুলি থেকে সন্তর্পণে সরে এসে নিজেকে ধ্বংস করে এক রকম নিষ্ঠুর প্রতিশোধের আনন্দ পাচ্ছে! সব বুঝে তার নিজেকে নিজের ভয় লাগছিল। ভাবল মৃত্যু বেশ কাছে চলে এসেছে।
মৃত্যুর ভাবনায় খুব অদ্ভুত একটা ব্যাপার হল। সবাই ছেড়ে যাওয়ার পর 'কেউ কাছে আসছে 'এই ব্যাপারটা নিয়ে সে এতটা অভিভুত হল, 'কেউ' টা যে মৃত্যু, তা সে খুব একটা অনুভব করল না। নি:সংগতা তার আর সহ্য হচ্ছিল না। এমন অবস্থায় সে তার বহু বছরের পুরানা এক বন্ধুকে ফিরে পেলো। অল্প বয়সের ঝগড়ার বন্ধু। এত বছর পরে দেখা! এর মধ্যে 'জীবন গিয়াছে চলে কুড়ি কুড়ি বছরের পার.. '
স্মৃতির দিনগুলি সময়ের হেরফেরে বদলে গেল। অল্প বয়সের স্মৃতি থেকে টুকরা টুকরা এটা সেটা তুলে আনতে আনতে মধ্যবয়সের স্বভাব, অভাব, অভিযোগ, প্রয়োজন, অপ্রয়োজন বিনিময় হতে থাকল। তারা এক সময় অনুভব করল তাদের একের জীবনে অন্যের উপস্থিতিটা আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে! প্রেম নয়, তার চেয়ে বেশি কিছু। গভীর একটা টান। একে অন্যের সব দু:খের দুখী হল তারা। সেহেলি নিরবে সব কষ্ট নিয়ে বন্ধুদের আসরে বসল। দু:খী বন্ধুকে আসরে ডাকল। বন্ধুদের সুখ থেকে ভাগ নেবে বলে। নিজেদের মধ্যে সুখ তৈরী করবে বলে। ওরা দেখল, ওরা সুখের কল্পনা করতে ভয় পাচ্ছে । সুখ তাদের সাথে সারাজীবন ছলনা করেছে। কষ্টকে বরং তারা বিশ্বাস করতে পারছিল। এক সময় দু:খী বন্ধু জানালো দু'জনের মাঝখানে একটা সমান্তরাল রেললাইন আছে। সে কষ্ট পাচ্ছে। সেহেলি তার বন্ধুর এই কষ্টটাও বুক পেতে নিল। কিন্তু তার আর বইবার শক্তি রইল না। সে চলতে চলতে ভারসাম্য হারাতে লাগল। এরপর হয়তো একেবারেই পড়ে যেত - কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম, মৌসুম বদলায়।
একদিন যাদুর মত সব বদলে গেল। দুজনেরই পুরনো এক প্রিয় বন্ধু ফিরে এলো। দু'জনই সুখী হল। বন্ধুকে মাঝখানে রেখে তারা নিজেদের মধ্যে সুখ দু:খ লেনদেন করে চলল। সেহেলি তার নি:সংগ সময়ের আনাচ কানাচ ভরে সুখ নিতে থাকল। দু:খী বন্ধু তার গুছানো জীবন এলোমেলো হওয়ার ভয় থেকে মুক্ত হয়ে নিশ্চিন্ত হল। কিন্তু মনের অজান্তে একান্ত নিজস্ব জগতে সে সেহেলির জন্য একটা জায়গা করে দিয়েছিল, সেই জায়গাটাতে শুন্যতা এসে তাকে কষ্ট দিতে লাগল। সেহেলি ফিরল না। সে তার সুখী বন্ধুর সাথে সাথে ঘুরে ঘুরে সুখ ফেরি করতে শুরু করল। তারা দু'জনে একটা সুখের গাছ লাগাল। তার শিকড়ে রইল স্বপ্নের মাটি আর দু:খধারা। গাছ জ্যাকের ম্যাজিক বীনের চারার মত রাতারাতি আকাশ ছুঁয়ে ফেলল। তা ফুলে ফলে ছেয়ে গেল।
ভাগ্যের পরিহাস! সুখী বন্ধুটা সুখ ছড়াচ্ছিল ঠিক, নিজে সেই সুখের একটা কণাও স্পর্শ করতে পারছিল না। সে সুখের ভান করতে শুরু করল। দিনে দিনে নিজের এই দৈন্য তাকে অস্থির করছিল। একদিন সেহেলি তার বন্ধুর এই অবস্থা দেখল। তার অপরাধবোধ হল। সে সুখের গাছটা পিছনে ফেলে একটা নির্জন পথ ধরে একা হাটতে শুরু করল। কেউ জানল না। শুধু সেই একদা সুখী বন্ধু জানল। সে সেহেলিকে খুঁজতে থাকল। খুঁজে পেলো। তারপর সে দেখল তার আর সেহেলির মাঝখানে নদী হয়ে বয়ে যাচ্ছে সংসার, সমাজ, ধর্ম!
নদীর এক কূলে বসল বন্ধু, অন্য কূলে সেহেলি। নদী বইতে থাকল। তাদের মন সাঁতার দেয় , নদী পার হয়, তারা নিরবে বসে দেখে।
"নদীর কূল নাই, কিনার নাই রে... "
বিষয়: সাহিত্য
৯৩৪ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনার লেখায় ভালোলাগা রেখে গেলাম! চালিয়ে যান........আপন মনে!
"নদীর কূল নাই, কিনার নাই রে... "
সত্য তাই, ধন্যবাদ আপনাকে।
শুধুই স্বার্থের প্রয়োজনেই একান্ত প্রিয় কিছু মানুষদের থেকে অযাচিত প্রত্যাখ্যান কারো জীবনকেই বিস্বাদ করে তুলে!
তখন সমস্ত প্রচেষ্টা কে ছাপিয়ে নিজ ধ্বংশই প্রবল হয়ে উঠে তার কাছে!!
কঠিন উপস্হাপনা মামুন ভাই!অনেক ভাল থাকার কামনা আল্লাহর কাছে!!
মন্তব্য করতে লগইন করুন